1b) চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত- চট্টগ্রাম আদিবাসী মানুষের পঠভূমী
একদিন শুক্রবারে জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামে এক মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছি বিভিন্ন মাত্রার কাল-বাদামী রঙের ও ছোট-মাজারি আকৃতির মানুষ। মানুষ মানে পুরুষ মানুষ- জুমার নামাজে মহিলাদের সমাগম চট্টগ্রামে দেখা যায়না। মানুষে মানুষের তফাৎ খুঁজতে গিয়ে সত্যি অবাক হয়ে দেখতে হয় কত বৈচিত্রমাত্রার হতে পারে বাদামী ও কাল রঙের চট্টগ্রামের মানুষের গায়ের রঙ – কেওবা কুচকুচে কাল, কেওবা ধুসর রঙের কাল, হাল্কা কাল, কালছে বাদামী, গাড় বাদামী, বাদামী, হাল্কা বাদামী, হাল্কা বাদামী সাদা ও গুলাপী সাদা। কি সুন্দর- বহুবিধ-বহুমুখী রঙের এই মনুহরি মানুষের উচ্চতা ৫ থেকে সাড়ে ৫ পাঁচ ফিট, কদাচিৎ ৬ ফিট। উচ্চতার দিক থেকে তেমন বিচিত্র না হলেও মুখের ও মাথার গঠন কছুটা ব্যাতিক্রমী। কেওবা দেখতে কিছুটা চাকমাদের মত (তিব্বতীয়-বার্মিজ), কেওবা পাকিস্তানী-আরব দেশীয় মানুষের মত, তবে বেশীর ভাগ মানুষ দেখতে বাঙ্গালীদের মত। সবার কাল চুলের রঙ্গে সদৃশতা থাকলেও মাথায় চুলের ঘনত্ব ভিন্ন ভিন্ন- কারও মাথা মরুভূমির মত চকচকে লোমহীন, আর কারওবা আমাজন জঙ্গলের মত ঘন চুল- মজার বিষয় পরিলক্ষিত হল লম্বা মানুষের চুলের ঘনত্ব বেশী আর বেশীর ভাগ খাট মানুষের চুলের ঘনত্ব কম। কারও চুল লম্বা আর কারও কুঁকড়ানো। মানুষে মানুষে কেন এই সুক্ষ্য বৈসাদৃশ্য তা জানার যাত্রাটা অনেক মুগ্ধময়। আপাত দৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও মানুষের চেহারার বিচিত্রতার পিছনে লুকিয়ে আছে দুরহ জেনেটিকেল রহশ্ম- আছে হরেক জাতির মানুষের চট্টগ্রামে বংশবর্ধনের উপাখ্যান। আর এই গুপ্ত কথা শুনতে হলে আমাদের চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ, কিংবা পশ্চিম বঙ্গের বাইরে গিয়ে ভারত মহাদেশের মানুষের বিচিত্রতার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে অসীম বৈচিত্রের ভারত উপমহাদেশের বাস করলেও, মানুষে মানুষের ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্নতা থাকলেও, জাতিগত ভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষরা এশিয়ার ও অন্যান্য মহাদেশের ভিন্ন জাতিগুত্র থেকে আপেক্ষিক ভাবে ভিন্ন। ভারত উপমহাদেশের মানুষের এই ভিন্নতা জানতে হলে আমাদের জানতে হবে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। ইতিহাস বীদদের মধ্যে মত বিরোধ আছে কারা এই অঞ্চলের আদিবাসী। আমি এই বিষয়টি নিয়ে অন্য একটা অংশে লম্বা আলোচনা করব। কিন্তু আপাতত ধরে নেই, অনেকের মতে, কয়েক হাজার বছর আগেও ভারত উপমহাদেশে বাস করত কয়েক ধরণের মানুষ- কেওবা ঈন্ডাস ভেলিতে কৃষি কাজ করত, তিব্বতীয়-বার্মানরা ছিল পাহাড়ি অঞ্চলে আর ছিল কিছু আদিবাসী সহজ সরল মানুষ- দেখতে কাল, অর্ধনগ্ন, ওঁ গুহাতে বসবাসকারী এই আদিবাসী মানুষরা এক জায়গায় নিজেরদের বসতি না গড়ে, ঘুরে বেড়াত এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। তখনো আদিবাসী মানুষরা কৃষির উদ্ভাবন দেখেনি- ছিলনা জানা ধান চাষ-কৃষি কাজ করার পদ্দতি, নেই কোন ফলমূল ফসল বাহী গাছ সম্পর্কে ধারনা। খিদা নিবারণের জন্য গুরে বেড়াতে হত তাদের এক অঞ্ছল থেকে আরেক অঞ্চলে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপের কারণে হোক, নতুবা প্রমাত্য নদীর প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে হোক, অথবা মশা, সাপ ও বাগের বহয়ে হোক চট্টগ্রামে মানুষের বসতির ইতিহাস তেমন প্রাচীন না। চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশ বয়সে নবীন একটা দেশ, দুই হাজার বছর আগের বিশ্ব ম্যাপে বাংলাদেশ সহ চট্টগ্রামের জনবসতির কোন ছিন্ন তেমন পরিলক্ষিত হয় না।
বয়সে হয়ত নবীন বলে নতুবা ধর্মীয় কারণে হোক অথবা বর্ণ বিভাজন না হওয়ার কারণে হোক বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পরম্পরাগত, চিরাচরিত ও ঐতিহ্যগত অর্চনা ও ক্রিয়াকাণ্ড মানুষে মানুষে কোন বিভাজন তৈরি হয়নাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলে বিভিন্ন গুত্রের মানুষ একে অন্য ধরনের মানুষের সাথে সংসার পেতে বংশধর বিস্তার করতে খুব একটা বেশী দেখা যায়না। কিন্তু বাংলাদেশ সেই ক্ষেত্রে বেতিক্রম। কিত্নু তারপরও মানুষে মানুষে সুক্ষ্য বৈসাদৃশ্য ও তাদের চেহারার বিচিত্রতার পিছনে এক মণ মুগ্ধ ও বিস্ময়কর গল্প লুকিয়ে আছে। এই গল্প জানা দুরহ হলেও, অসম্ভব নয়। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের আভিবাসনের ইতিহাস জানলে, বিভিন্ন শাসন আমলের রাজা প্রজাদের বংশধরদের কাহিনী শুনলে আর মানুষের জিনেটিকেল বংশ পরম্পরা দেখলে চট্টগ্রামের মানুষ সম্পর্কে অনেক বেশী ধারণা পাব।
One thought on “1b) চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত- চট্টগ্রাম আদিবাসী মানুষের পঠভূমী”
Comments are closed.
Nice piece of writing Nazim bhai. Waiting to get more on Ctg cultute.